চিকিৎসক অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ওটা তাহলে পোষা? বাড়িতেই থাকে! দেন মাই ডিয়ার, ওয়াচ ইট। ওয়াচ ফর নেক্সট টেন ডেজ। যদি ওটা তার মধ্যে মারা যায় বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলেই তোমাকে অ্যান্টি র্যাবিশ ইনজেকশন নিতে হবে। না হলে নয়! গো, ওয়াচ ইট। ওয়াচ কনস্ট্যানটলি।’
সেই থেকেই কৈশোর-যৌবনের মাঝামাঝির প্রদীপ সেনের ‘দ্য ডগ ওয়াচার’ উপাধি লাভের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলা। ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। তাই জানা দরকার সে দিন ঠিক কী কী ঘটেছিল।
প্রিয় বন্ধু অশিসের পরিবারের বসবাস এক বাগানবাড়িতে। চারিদিকে নাম না জানা ফুল আর ফলের গাছ। সেগুলি সম্পর্কে জানতে চাইলেই আশিস অদ্ভুতভাবে নাক ফুলিয়ে ফেলত। তারপরে বলত, ‘ও সব পূর্বপুরুষের আমলের গাছ। আমি কী করে বলব! আমার জন্মের আগে থেকেই ওসব এ বাড়িতে রয়েছে।’ তার সেই ফুলে ওঠা নাক আসলে আভিজাত্য না কি বংশগৌরব, তা বুঝে ওঠার মতো জ্ঞান হয়নি তখন প্রদীপের।
আশিসের সঙ্গে এমনিতেই তাঁর ছিল গলাগলি ভাব। এমনকী কেউ কাউকে বেশিক্ষণ না দেখে থাকতেও পারতেন না। কিন্তু এই ভাব আশিসের বাড়ির লোকেদের পছন্দের তালিকায় ছিল না। তেমনি তা ছিল না তাদের বাড়ির পোষা অ্যালশেসিয়ান আর নেড়ির ক্রস ব্রিড, ড্যানির। সে সারমেয়টি নিজেকে সবসময় জাতের কুকুর বলে ভাবত। জীর্ণ পাঞ্জাবিতে ঢাকা প্রদীপকে দেখতে পেলেই সে তারস্বরে ডাক ছাড়ত। সে ডাক শুনে আশিসের বাড়ির অন্তঃপুরের ষোলো টু ষাট বলে উঠতো, অ্যাই! সেই হাভেতেটা চলে এসেছে গো!
তাতে অবশ্য প্রদীপ-আশিসের মধ্যে বন্ধুত্বের যেত-আসত না কিছুই। তারা নিজস্ব জগতে হারিয়ে যেত সমস্ত কিছু উপেক্ষা করেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা কথা বলত কত কিছু নিয়ে। বেশিরভাগই পাড়ার উঠতি কন্যাদিগের স্ট্যাটিস্টিকসের পরিসংখ্যান। কিন্তু গোলমাল পাকালো ড্যানিই! প্রদীপ শুনেছিল, ইংরেজিতে প্রবাদ রয়েছে, বার্কিং ডগ ডাজন্ট বাইট। যে কুকুর ঘেউঘেউ করে, সে কামড়ায় না! এই প্রবাদে বিশ্বাস করে একদিন, ড্যানির প্রচণ্ড চিৎকারে বিরক্ত প্রদীপ ওর শরীরের উপরে ফেলে দিয়েছিল দাঁড়িয়ে থাকা একটি সাইকেল! ড্যানির চিৎকারটা ততক্ষণে কেঁউ-কেঁউতে নেমে এসেছে দেখে পরিতৃপ্ত প্রদীপ ভেবেছিল, যাক এতদিনে উচিত শিক্ষে দেওয়া হল। ও আর কামড়াবে না। ইংরেজিতেই বলা হয়েছে, বার্কিং ডগ ইত্যাদি…। ঘেউঘেউটাও এতদিনে বন্ধ হবে।
ড্যানিও এই সাইকেল পর্বের পরে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। অন্তত প্রদীপের সামনে। কিন্তু এ যে তার আক্রমণের ছক্, তা ধরতে পারেনি প্রদীপ। চোখ মিটমিটিয়ে প্রদীপকে, দেখতে-দেখতে একদিন সে বায়ুগতিতে ধেয়ে আসে, আর তার এই ধেয়ে আসা দেখে পলাতক প্রদীপের নিতম্বে প্রায় সবকটি দাঁত গেঁথে দেয়। সেই কামড়ের জেরেই প্রদীপ সেনকে জলাতঙ্কের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুটতে হয় চিকিৎসকের চেম্বারে। তারপরে সেই পর্যবেক্ষণের উপদেশ লেখা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফিরে আসা।
দু-একটা কথা নয়! কুকুরদের সম্পর্কে প্রদীপ সেন অনেক কিছুই জানে। অন্তত ৯৯৯ বার সে দেখেছেন তাদের আশ্লেষ সঙ্গম। দেখেছেন সঙ্গমের আগে কুক্কুরীদের তীব্রপ্রতিবাদ জানাতে। কুকুরেরা যদি মানুষ হতো, তাহলে সেই তীব্র, ‘ক্যাঁই ক্যাঁই’ শব্দে পথচারীরা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে পড়তেন। থানা থেকে খবর পেয়ে ছুটে আসত পুলিশ। না এলে, সেই উদাসীনতা নিয়ে পরে সোচ্চার হতো মিডিয়া। কুকুরদের সমাজে কোনও পুলিশ নেই বলে, এই ধর্ষণের আগে বিচদের তারস্বরে চিৎকার, পাত্তা পায় না। পথচলতিরা, যে যার মতো, নির্বিকার হেঁটে যান! শুধু রয়ে যায়, শূলবিদ্ধ একটি কুক্কুরীর চারপাশে, ল্যাজ নাড়তে থাকা সারমেয়যূথ। সেই লঙ্গুলিহেলন বলে, ‘লাইনেই রয়েছি, স্যার। আপনারটা শেষ হলে আমরাও উপগত হতে চাই। ওয়ান বাই ওয়ান, প্লিজ। এটা আমাদের জন্মগত, ভাদ্রমাসগত অধিকার!’
সেই কুকুরদের এই আচার, বিহার-বিচরণ বা যৌনসম্পর্কের খোঁজ রাখুক বা নাই রাখুক, প্রদীপ সেনকে দেখা যায় এ ব্যাপারে প্রচণ্ড রকমের আপটুডেট। বলা যেতে পারে, প্রদীপ সেন, আসলে, সত্যিকারের ডগ-ওয়াচার। কত লোকে তো কত প্রাণীকে ওয়াচ করে। তাঁদের নিয়ে ফলাও করে এপিসোডের পর এপিসোড হয় ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফি বা অ্যানিম্যাল প্ল্যানাটে। কিন্তু এঁদো গলির নেরিটোরিয়ানদের নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কোনও এপিসোডের কথা ভাবতেও পারেনি। আর পারেনি বলেই, প্রদীপ সেনের খোঁজ পড়েনি। ভাবলে, অবশ্যই তাকে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে দেখা যেত।
এই যে প্রদীপ সেন তার বপু, ছাতা ও বাজারের ব্যাগ সামলে-সুমলে গলি থেকে বের হলেন, আর তাকে দেখতে পেয়েই গলির র্যাম্বো, ভোলা একটা লম্বা ফ্লাইং ওভেশন দিল, তা দেখে কে আর কী বুঝল? প্রদীপ কিন্তু বুঝলে গম্ভীর গলায় বললে, ‘কী রে, কেমন আছিস? এত রোগা হয়ে গেলি কী করে?’
গত রাতেই বেপাড়ার মাস্তান ঝন্টু এখানে নিজস্ব সাগরেদদের নিয়ে টহল দিতে এসেছিল। প্রদীপদের সেই সার্পেন্টাইন লেনের উঠতি সুন্দরী ডিম্পলকে চেটে ও শুঁকে দেখাই ছিল এই টহলের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্ত তাতে ভোলার প্রেস্টিজে বড় রকমের আঘাত লাগে। ফলে দু’দলের মধ্যে গত রাতে একটা রক্তাক্ত সংঘর্ষ ঘটেছে। আর সেই সংঘর্ষের প্রচণ্ডতায় পাড়ার লোকেদের ঘুম চটকে চামচিকে! লাঠি হাতে আস্ফালন, সংঘর্ষরতদের উদ্দেশে দু’তলা, তিনতলা থেকে ইঁট পাটকেল প্রয়োগেও থামানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই রাতের ঘুম ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল।
ভোলা বলল, ‘কী করব গুরু! আজকাল তো সবাইকে সামলে রাখতে-রাখতেই দিন কাবার। ডাস্টবিনের কাছে যাবার ফুরসত কোথায়? স্রেফ খালি পেটে এই পাড়ার ইজ্জত রক্ষা করে চলেছি, বুঝলে। এখনকার উঠতি ছুঁড়িগুলোর কি লাজলজ্জা আছে? কোথায় সেই পটাইয়ের মা, টমের মাসিরা! যারা শুধু একনিষ্ঠভাবে নিজেদের যৌবন তুলে দিত পাড়ার যুব সম্প্রদায়ের হাতে! দিনকাল কী এলো গুরু?’
পাশ কাটিয়ে যাবার সময় প্রদীপ সেন শুনতে পেল, ভোলা বলছে, ‘অনেকদিন হয়নি। মানে, তোমার বাড়ি থেকে তেমন হাড়গোড় মেলেনি। শুধু মাছের কাঁটা-টাঁটাই পড়ছে ডাস্টবিনে। আজ একটু তাগড়াই রাংয়ের হাড় মিলবে? তাহলে জোশ এসে যায়। কাল রাতে তো অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে ডুয়েলে। আমি কিন্তু ঠিক আড়াইটের সময় ডাস্টবিনের সামনে অপেক্ষায় থাকব।’
আর কয়েক কদম যেতেই প্রদীপ সেনের পথ আটকে দাঁড়াল মেনকা। মেনকার বয়স হয়েছে। এ পাড়ায় তার অন্তত তিরিশটা বাচ্চা বড় হয়ে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। মেনকা অভিযোগের সুরে বলল, ‘এটা কী হচ্ছে বস্? পাড়ার কচি মেয়েগুলোর দিকে ওই বুড়ো হাবড়াগুলো যে ক্রমাগত বেশি করে ঢলেঢলে পড়ছে? আমাদের মতো বুড়িদের কি গয়া-কাশি যেতে হবে না কি? আমাদেরও তো ভাদ্দরমাস আছে, না কি? তুমি ভোলাকে বলে দাও, ওর মহব্বতের একটা পার্সেন্টেজ যেন আমার জন্য তুলে রাখে। হাজার হলেও আমি তো আর ছেলেছোকরাদের দিয়ে তেষ্টা মেটাতে পারি না। আমি বলে পুরনো দিনের খানদানি মিসট্রেস!’
প্রদীপ স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিল হ্যাংলার অনৈতিক সাহস দেখে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, কুকুর তো আর মানুষ নয়! পুত্রবধূকে সঙ্গমে চাইতেই পারে সে। আদিম কালে মানুষও এমন ছিল। কত পরে তো মনু এসে বিবাহের বিধান দিলেন। সেই থেকে মানুষের জীবনে এল অবৈধ সম্পর্ক। এক্সট্রা ম্যারিট্যাল রিলেশন। বাঁধন দিলে তো, তা কেটে বেরিয়ে যাবার প্রচেষ্টা থাকবেই। প্রমিথিউস আনবাউন্ড!…
প্রদীপ সেনের সঙ্গে এরপরে দেখা হলো বুড়োর। বুড়োর পাড়া প্রচলিত ডাকনাম হ্যাংলা। খাওয়া থেকে সবকিছু নিয়েই তার হ্যাংলামি। সে বাস্তবে ভোলাপ বাপ। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, কুকুর জীবনের প্রায় অন্তিম লগ্নে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু তাতেই বা কী? হ্যাংলা বলল, ‘বাবু একটা অনুরোধ ছিল। আমার জীবন শেষের দিকে ঠিকই। বলতে গেলে আমি এখন যমরাজার ডাকের অপেক্ষায় আছি। ডাকটা এলেই দেখবে, আমি চার পা আকাশেতুলে ফুলে ফেঁপে, মরে পড়ে রয়েছি। পাছায় পড়েছে জ্যোৎস্না! তার আগেশেষবার, শেষতম বারের জন্য আমাকে একটা সঙ্গিনী জুটিয়ে দাও। সবকটাকে ভোলা দখল করে রেখেছে।’
প্রদীপ সেন মুখ খুলতে বাধ্য হলেন, বললেন, ‘ভেবে দেখ, তুমিও তো তাই করতে যতদিন ফর্মে ছিলে, ততদিন তুমিই তো ছিলে পাড়ার সকল কুক্কুরীর ভাদ্রমাসের ব্রত উদযাপনের পুরোহিত। ভোলা এখন ফর্মে। ও তোমার ছেলে। তোমার রাস্তাই নিয়েছে। দুঃখের আর কী?’
হ্যাংলা বলল, ‘দুঃখ করছি না। শুধু বলছি, আমাকে জীবনে শেষবারের মতো, একবার সুযোগ দেওযা হোক। আমার শেষতম বীজটাকে পুঁতে দিয়ে যেতে চাই। সকলেই তো নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে চায় সন্তানের মধ্যে।’
প্রদীপ সেন চলে যাচ্ছিল, তার পথ আটকে দাঁড়াল হ্যাংলা। চাপা স্বরে বলল, ‘আমি খবর পেয়েছি মেনকা এবার আর ভোলার নেকনজরে নেই। ও এবার সিঙ্গল রয়েছে। ওকেই কোনও মতে পাঠাও না। শেষবারের মতো…।’
প্রদীপ স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিল হ্যাংলার অনৈতিক সাহস দেখে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, কুকুর তো আর মানুষ নয়! পুত্রবধূকে সঙ্গমে চাইতেই পারে সে। আদিম কালে মানুষও এমন ছিল। কত পরে তো মনু এসে বিবাহের বিধান দিলেন। সেই থেকে মানুষের জীবনে এল অবৈধ সম্পর্ক। এক্সট্রা ম্যারিট্যাল রিলেশন। বাঁধন দিলে তো, তা কেটে বেরিয়ে যাবার প্রচেষ্টা থাকবেই। প্রমিথিউস আনবাউন্ড! বলল, ‘বলে দেখব। তবে মেনকা খুবই সতীলক্ষ্মী কি না!’…
ছেলেবেলায় প্রায়ই জ্বরে ভুগত সে। তার রাশভারী বাবা ছেলেকে ভালবাসতেন। অসুস্থ ছেলের সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকার একঘেয়েমি কাটাতে অফিস ফেরত তিনি নিয়ে আসতেন টার্জানের কমিকস। সেই ইংরেজি সাবটাইটেল দেওয়া কমিকস পড়ে শোনাতেন ছেলেকে। এই কমিকসের কল্যাণেই প্রদীপ সেনের চারদিকে গজিয়ে উঠত আস্ত ও গহন অরণ্য। তাতে গোরিলা ঘুরত। সবকিছুর মাঝে গাছের ঝুরি ধরে দোল খেতে খেতে টার্জন ওরফে লর্ড গ্রেস্টোক জুনিয়র আসতেন, ‘আআআউউউ’ ডাক ছেড়ে।
এই কমিকসের প্রভাবেই প্রদীপ একদিন বিশাল উঁচু এক পাঁচিল থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়েছিল। আশা ছিল, টার্জানের মই উড়ে গিয়ে ধরে ফেলতে পারবে, কাছাকাছি থাকা আমগাছের ডাল। বিধি বাম! ডাল পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে প্রদীপ পড়ল বেশ কয়েক ফুট নিচে। পড়ে গিয়ে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে তাঁর জ্ঞান ফিরলেও, দুর্ঘটনার পরে টার্জানের অরণ্য-জগতে তলিয়ে যাওয়া তার বন্ধ হল না। ছোটবেলায় টার্জান মানুষ হয়েছিলেন গোরিলার দুধ খেয়ে। কালা নামে সেই গোরিলা-মা ছিল টার্জানের সব। বিমান দুর্ঘটনার পরে গাছ বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া টার্জানের বাবা-মা, দুই লর্ড আর লেডি গ্রেস্টোকের মৃত্যুর পরে অযুত বিপদ থেকে, শিশু টার্জানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সেই গোরিলা-নারী কালা।
প্রদীপ সেন নিজেকে টার্জান-ই ভাবত। কোমরে গুঁজে রাখত কাঠের ছুরি। কিন্তু দুর্গাপুরের বুকে গোরিলা পাবে কোথায়? চারিদিকে কিলবিল করত কুকুর। ঠিক করলে গোরিলার বদলে কুকুরের দুধ খাবে। টার্জান না হতেপারলে, কাছাকাছি তো যেতে পারেন। লম্ফেঝম্পে অন্তত। তাই এক সকালে এক দুধেল কুক্কুরীকে টার্গেট করলে সে, তার বাঁটে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ করে যখন দুধ টানছে, ঠিক তখনই ঘটল সেই কাণ্ডটা!
না, কুক্কুরী কোনও প্রতিবাদ করেনি। দুগ্ধপানে বঞ্চিত, তারই সদ্যোজাত এক সন্তান, প্রদীপ সেনের হাঁটুতে কামড়ে কয়েক আউন্স মাংস তুলে নেয়। ফলে প্রদীপ সেনের নিচে পরপর ঢোকে গোদাগোদা চৌদ্দোটি ছুঁচ বা ইঞ্জেকশন! বেচারি আর কোনও দিনই কুকুরের দুধ খেতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর পার করে প্রদীপ যখন আপিসে কাজের সন্ধানে মানে, ঠিকেদারিতে ঢোকে, ঠিক তখনই তার এই কুকুরদের ভাষা বোঝা ও বলার ক্ষমতা দেখা যায়। তবে তার এই আশ্চর্য ক্ষমতা সে কারও কাছেই প্রকাশ করেনি। চেপেচুপে রেখেছিল।
একদিন রাতে একা গলি দিয়ে ফিরছিল প্রদীপ। গলিটি অল্প চেনা। শুধু শর্টকার্ট করার লোভে সেই অন্ধকার গলিতে এক পার্টিতে হুইস্কি পানের জেরে ঈষৎ বেসামাল পায়ে হাঁটছিল। যেতে যেতে একটা কুকুরের চাপা গলার ডাক ভেসে এল। অন্যেরা কিছুই বুঝল না। কিন্তু প্রদীপ সেন শুনে দিব্যি বুঝতে পারল সেই অচেনা-অজানা কুকুর বলছে, ‘গলিতে ওরা কারা? এতগুলো লোক হাতে ছোরা-পিস্তল নিয়ে কার অপেক্ষায় রয়েছে! মানুষ তো বিপদে পড়বে, বাপু!’
কুকুরকণ্ঠে সেই সাবধানবাণী শুনে প্রদীপ একটা দেওয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল। এবং কোনও মতেই সেই হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেনি। সেই রাতে তার পরনে ছিল কালো কোটপ্যান্ট। তাই সে অন্ধকারে, অন্ধকার হয়েই মিশেছিল। ফলও পেয়েছিল হাতে-নাতে। তাকে অতিক্রম করে সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে পরপর কতজন যে উদ্যাত আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে সর্বস্ব খোয়ালেন! শেষে প্রদীপ গলি ছেড়ে বের হয়ে রাজপথে এসে, একটি টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে লালবাজারে। পরের দিন সব সংবাদপত্রে কুখ্যাত ছিনতাইবাজ, কালো সদাশিবের গ্যাংকে পুলিশের তৎপরতার সঙ্গে গ্রেপ্তারের খবর বের হয়েছিল। কিন্তু কুকুরেরা, মোটেই গরিবদের যে পাত্তা দেয় না, সেটা বুঝতে প্রদীপের সময় লেগেছিল। এই সময়টা বোধহয় সব গরিবেই লাগে। গরিবের পাশে রোদ-জল-ঝড়ে বেঁচে থাকা কুকুরেরা আসলে যে এক ও একমাত্র বড়লোকদেরই প্রকৃত বন্ধু বা পদলেহনকারী, তা নাকের জলে, চোখের জলে এক রাতে বুঝতে পেরেছিল সে। কিন্তু সারমেয়দের হাতে কিছুই ছাড়তে চায়নি। মাংসের ভাঁড়ও না!
এই মাংসের ভাঁড়কে কেন্দ্র করে প্রদীপ সেন বনাম রাস্তার কুকুরদের লড়াইয়ের গল্পের আগে, অন্য একটি গল্প বলে নেওয়া যেতে পারে। সেটি প্রদীপ সেনের খটকার গল্প। গরিবদের সম্পর্কে কুকুরদের মনোভাব বুঝে ওঠার চেষ্টা শুরু করেছিল, এই ঘটনার পরেই।
রাস্তা দিয়ে একটি মিছিল যাচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় এই ধরনের মিছিল প্রায় প্রতিদিনই, প্রতিটি সড়ক থেকে গলি, তস্য গলি দিয়ে যায়। শহরের কোনও একটি সমবায়ের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছিল বামপন্থী প্রার্থীরা। সেকালে এই ধরনের সমস্ত নির্বাচনে বামপন্থীরাই বিপুল থেকে বিপুলতর ভোটে জিতত। বিপক্ষে হয় কোনও প্রার্থী দাঁড়াত না। দাঁড়ালেও জামানত বাজেয়াপ্ত নিশ্চিত।
শেষ পর্যন্ত প্রেমিকাকে পটিয়ে-পাটিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ইলোপ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয় সে। তার পাশের পিঁড়িতে বসে নিজের দাম্পত্য জীবনের সূচনা করে। কিন্তু তখন নেহাতই কয়েকটি টিউশনি সম্বল। অর্থাৎ ঠিকে ঝিদের প্রায় সমান্তরালই স্ট্যাটাস তার। প্রদীপ তখন নেহাতই গরিব, নিরীহ ও ঝামেলা এড়িয়ে চলাদের দলে। দাম্পত্যের সূচনার কিছু দিন পরেই, প্রেমিকা থেকে প্রোমোশন পেয়ে বধূ হয়ে ওঠা তিন্নি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তার তীব্র অরুচি। কিছু খেতে পারছে না। তাই মেজাজটিও তিরিক্ষে। তিন্নি সেদিন হুকুম করেছে, স্বামী যেন ফেরার পথে তার জন্য পাঞ্জাবি হোটেল থেকে মাংস কিনে আনে। সেই মাংস খরিদের পরে প্রদীপ সেন পদব্রজে চলেছিল বাড়ির পথে।
মিছিলের সময় রাস্তা পারাপার করা সম্ভব নয়। প্রদীপ যাচ্ছিল তার প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে। সেই কিশোরী দীর্ঘদিন পরে তার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রদীপের বুকে বইছিল খুশির তুফান। সে সাইকেলে যেতে যেতে দেখে, রাস্তার কুকুর ডন তার দীর্ঘপুচ্ছটিকে টানটান করে উঁচিয়ে ধরেছে। এই পুচ্ছটিকে এমন লাঠির মতো তুলে ধরা বেড়ালদেরই স্বাভাবিক প্রবণতা। কুকুরদের মধ্যে তা দেখা যায় না। সম্ভবত ডন রাস্তার মিছিলকারীদের হাতে দীর্ঘ লাঠি-সড়কি আকাশের দিকে তুলে ধরা দেখে প্রভাবিত হয়েছিল, ভীষণ রকমের প্রভাবিত!
প্রদীপ বাঁ-পা দিয়ে ডনের সে দীর্ঘ পুচ্ছে একটা টোকা মেরে নেহাতই লঘু স্বরে বলেছিল, ‘অমুকবাবু খেয়েছে ল্যাং! খেয়েছে ল্যাং!’ রাস্তায় যাতায়াতের কালে সে এই ডনকে নিজের বিড়ির জন্য রাখা সামান্য অর্থ থেকেও বিস্কুট কিনে খাইয়ে থাকত। তার মনে হয়েছিল, এটুকু ঠাট্টা ডন খোলা মনেই নেবে। বড় জোর চাপা গলায় পাল্টা ঠাট্টা করে বলতে পারে, ‘কী রে! তোর বড্ড বাড় বেড়েছে? যা যা, তোর বুঁচিটা তো দাঁড়িয়ে রয়েছে কদমতলায়!’
কিন্তু এ সবের কিছুই ঘটেনি! উল্টে ডন শ্বদন্ত পর্যন্ত বের করে তেড়ে আসে! সে কামড়াবে, কামড়াবেই! এতটাই অপমানিত হয়েছে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে প্রদীপ দ্রুত সাইকেলের প্যাডেল মারতে থাকে কুকুর আর মানুষের এই রেসে, ছুটতে ছুটতেই ডন বলতে থাকে ‘বিজয় মিছিলে ছিলাম। আমি অমুকবাবুর লোক যে, তুই আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করলি! আজ তোকে আমি ছিঁড়ে খাব!’ বলা বাহুল্য, প্রদীপের সেদিন আর কদমতলায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করা হয়নি। সেটা যে ডনেরই এলাকায়!
পরের ঘটনা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটে। শেষ পর্যন্ত প্রেমিকাকে পটিয়ে-পাটিয়ে বাপের বাড়ি থেকে ইলোপ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয় সে। তার পাশের পিঁড়িতে বসে নিজের দাম্পত্য জীবনের সূচনা করে। কিন্তু তখন নেহাতই কয়েকটি টিউশনি সম্বল। অর্থাৎ ঠিকে ঝিদের প্রায় সমান্তরালই স্ট্যাটাস তার। প্রদীপ তখন নেহাতই গরিব, নিরীহ ও ঝামেলা এড়িয়ে চলাদের দলে। দাম্পত্যের সূচনার কিছু দিন পরেই, প্রেমিকা থেকে প্রোমোশন পেয়ে বধূ হয়ে ওঠা তিন্নি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তার তীব্র অরুচি। কিছু খেতে পারছে না। তাই মেজাজটিও তিরিক্ষে। তিন্নি সেদিন হুকুম করেছে, স্বামী যেন ফেরার পথে তার জন্য পাঞ্জাবি হোটেল থেকে মাংস কিনে আনে। সেই মাংস খরিদের পরে প্রদীপ সেন পদব্রজে চলেছিল বাড়ির পথে।
এই পর্যায়ে প্রদীপের পাদুকার একটা বর্ণনা দিতে পারলেই পাঠকদের কাছ স্পষ্ট হয়, তিনি কী ধরনের পরিস্থিতিতে তখন ছিলেন। তাঁর পায়ে হাওয়াই চপ্পল। তার স্ট্রাপ ছিন্ন হয়েছে বেশ কয়েকদিন। তাতে সেফটিপিন। সেই অবস্থাতেই কার্যত পা ঘষে-ঘষে ফিরছিল হাতে মাংসের ভাঁড় ঝুলিয়ে-দুলিয়ে। সেই ভাঁড়ের ভেতর কষ্টের টাকায় কেনা কয়েক টুকরো মাংস সাঁতার দিচ্ছে গ্রেভির সমুদ্রে!
প্রদীপের মন অসম্ভব ভাল। তবু তো সে স্ত্রীর কথা রাখতে পেরেছে। কতদিন পরে ভাতের মদ্যে আজ মাংসের ঘ্রাণ। গর্ভবতী, দুর্বল স্ত্রীর মুখে অতিরিক্ত দু’-গ্রাস ভাত! তাই প্রদীপের নিজেকে শাহজাহান বলে ভুল হচ্ছিল। একান্ত মমতাজের জন্য সে বয়ে নিয়ে চলেছিল এক টুকরো তাজমহল। দ্যাট ইজ— ওই মাসের ভাঁড়।
আচমকা পিছনে অসংখ্য খটখট শব্দে স্বপ্নচ্যুত হয়েছিল প্রদীপ দ্য শাহজাহান। নির্জন গলির মিটমিটে বাতিস্তম্ভ তাকে দেখিয়েছিল একপাল কুকুরের ছুটে আসা। তাদের জিভ লকলক করছিল। দাঁত ছিল প্রকটিত। নখ আর পাথুরে গলির মধ্যে ঠোকাঠুকিতে ওই খট খট খট …। একপাল হিংস্র নেকড়ের মতোই দেখাচ্ছিল তাদের। প্রদীপের বুঝতে ভুল হয়নি, ওদের টেনে এনেছে ওই মাংসের ভাঁড় বা তার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া গন্ধ!
প্রদীপ একবার ভেবেছিল, ভাঁড়টাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাই। প্রাণটা তো বাঁচে। কিন্তু তখন তার পকেটে আর একটি আধলাও নেই যে, বাড়ি ফিরবে ফের একভাঁড় মাংস কিনে! বাধ্য হয়ে হিংস্র নেকড়ের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। হাত যথাসম্ভব উঁচুতে তুলে সেই ভাঁড়টিকে আকাশে রেখেছিল সে। কিন্তু তাঁকে বিস্মিত করেই উঁচুতে তোলা ঝুলন্ত ভাঁড়ের দিকে লাফ দিয়ে উঠছিল কুকুর কাম পরিবর্তিত পরিস্থিতির নেকড়েরা! প্রদীপের মনে হচ্ছিল, আকাশের চাঁদও বোধহয় পেড়ে নেবে ওই লম্ফবাজেরা।
মাংসের ভাঁড় থেকে গড়িয়ে পড়ছিল গরম ও প্রচণ্ড ঝাল গ্রেভি। তা টপ্ টপ্ করে পড়ছিল প্রদীপের গায়ে, মাথায়, চোখে। কুকুর কাম নেকড়েরা তার শরীরে ভর দিয়ে গড়িয়ে পড়া গ্রেভিও চেটে খাচ্ছিল। আর হাড়হিম করা, ঔঔঔঔঔ ডাক ছাড়ছিল। প্রদীপ বুঝতে পারছিল, হামলাকারীরা বলছে, লোকটার টুঁটি কামড়ে ধরলেই ভাঁড়টা মাটিতে পড়ে যাবে! আমরা হামহাম করে ভাঁড়শুদ্ধ খেয়ে নেব। আহা কতদিন মাংস খাইনি গো।
কতক্ষণ ধরে সে ওই ভাঁড় বা তাজমহল বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, তা হলফ করে বলতে পারবে না। আচমকা তার পাশ দিয়ে স্পিডে যেতে যেতে প্রচণ্ড ব্রেক কষেছিল একটি মারুতি ভ্যান। সেই ভ্যানের দরজা খুলে দিয়ে বন্ধু শংকর বলেছিল, ‘আরে! প্রচণ্ড বিপদে পড়েছিস। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়।’
ব্রেকের কর্কশ শব্দে সেই নেকড়েরা নিমেষে নেড়ি বনে গিয়েছিল! তাদের ল্যাজ, পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে গিয়েছিল অজানা আশংকায়। প্রদীপ দ্রুত মারুতি ভ্যানের সিটে উঠে পড়ে। ভাঁড় ও প্রাণ সমেত। বন্ধু আলোতে তার সর্বাঙ্গ দেখে বলেছিল, ‘এ হে হে! ঝোলে একেবারে স্নান করে ফেলেছিস! আমার সিটটাতে বেশি রগড়াস না। তাহলে আবার গাড়ির সমস্ত তোয়ালে কাচতে হবে।’ নেড়িরাও, বলা বাহুল্য, গাড়ি তাড়া করে আসেনি। ফোর-হুইলার তো ধনাঢ্য সমাজের প্রতিনিধি, সেটা কি আর জানে না তারা!
কুকুরেরা যে গরিবদের পাত্তা দেয় না, এমনকী দরিদ্রদের অসহায়, বধ ও বলাৎকারযোগ্য বলে মনে করে, তা এই ঘটনার পরে প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রদীপ দেখল বিশাল এক অস্ট্রেলিয়ান হাউন্ড তাকে নিরীক্ষণ করছে। তার মুখের খোলা অংশ দিয়ে বড়সড় ধারালো দাঁতের আভাস মিলছে। কুলোর মতো জিভটি ঝুলছে। সম্ভবত এই প্রাণীর পূর্বপুরুষকে চাক্ষুষ করেই কোনান ডয়েল ‘হাউন্ড অবদ্য বাস্কারভিলস্’ নামের শার্লক হোমসের রোমহর্ষক কাহিনিটি লিখেছিলেন। পিছনে খচমচ খচমচ শব্দে প্রদীপ টের পেলে, সঙ্গীরা পালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীটি, কারখানা অফিসারের হাউন্ডটি যে আসলে কুক্কুরী, ততক্ষণে তার কুলোর মতো জিভ প্রদীপের সর্বাঙ্গে বুলিয়ে চলেছে। বলছে, ‘আই লাভ ইউ! লাভ ইউ!’
এরপর প্রদীপ সেনের অবস্থা ফিরল। তার গ্যারাজে অচিরেই দেখা দিল নতুন নতুন চার চাকার যান। তার বধূ একে একে তাকে উপহার দিলে সন্তানদের। প্রদীপের ধনদৌলত উপচে পড়ল। সে এরপরে কিনল একটি বিলিতি কুকুর। সেই কুকুর, যার নাম কুট্টুস, সে তাদের খেলাচ্ছলে, কামড়ে-আঁচড়ে-ভালবেসে একাকার করে দিল। পরিবারের প্রতিজনেরা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল কুকুরের হর্মোন। সেই হর্মোন একমাত্র কুকুরদেরই ঘ্রাণে ধরা পড়ত। ফলে প্রদীপের শরীর ঘিরে গড়ে উঠল এক নিরাপত্তার ঘ্রাণ-বলয়। এই বলয় তাকে, পাড়া-বেপাড়ার কুকুরদের কাছে আনরিচেবল, মায় আনটাচেবল করে তুলল। এই কাহিনি অর্থাৎ প্রদীপ সেনের গবেষণার ফলাফল প্রমাণে প্রচণ্ড সাহায্য করল। ওই ঘ্রাণবলয়। কী করে করল, সেটাই এই পর্যায়ের শেষ কাহিনি।
প্রদীপ সেন দুর্গাপুরে গিয়েচিল। তাকে ঘটনাচক্রে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার এক বৃহৎ অফিসারের কাছে উপঢৌকন-সহ প্রণামী দিতে যেতে হয়েছিল। ওই অফিসারের হাতে ছিল এমন কয়েকটি কনট্রাক্ট, যা পেলে ঠিকাদারেরা উল্লাস করতেন। আর প্রদীপ সেনের বাড়বাড়ন্ত তো ঠিকেদারিতেই!
তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন জুটে গিয়েছিল। তাদের কাজ ছিল এই দু’ধনী হাতে টাকা ছড়ানো সুপুরুষ ঠিকেদার সম্পর্কে কারখানার ওই অফিসারের কাছে অনবরত প্রশংসা করা। সেই কাজটাতেই তারা চলেছিলেন প্রদীপের সঙ্গে। বাংলোর গেটে ‘বি ওয়্যার অব ডগ’ বা ‘কুকুর হইতে সাবধান’ বাণীটি লিখিত ছিল। এমন শব্দ ভিখিরি বা সেলসম্যান ঠেকাতে তো কত জায়গাতেই লেখা থাকে। সে কোনওটিই নয়। প্রদীপ সেন তাই সে বিজ্ঞপ্তি উপেক্ষা করে। সঙ্গীরাও করে ফেলে গেট খুবলার ক্যাঁচচ্ শব্দটি। ওঠা মাত্র বিশাল বাছুরের আকারের একটি প্রাণী প্রদীপের দু’কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ায়!
প্রদীপ দেখল বিশাল এক অস্ট্রেলিয়ান হাউন্ড তাকে নিরীক্ষণ করছে। তার মুখের খোলা অংশ দিয়ে বড়সড় ধারালো দাঁতের আভাস মিলছে। কুলোর মতো জিভটি ঝুলছে। সম্ভবত এই প্রাণীর পূর্বপুরুষকে চাক্ষুষ করেই কোনান ডয়েল ‘হাউন্ড অবদ্য বাস্কারভিলস্’ নামের শার্লক হোমসের রোমহর্ষক কাহিনিটি লিখেছিলেন। পিছনে খচমচ খচমচ শব্দে প্রদীপ টের পেলে, সঙ্গীরা পালিয়ে যাচ্ছে। প্রাণীটি, কারখানা অফিসারের হাউন্ডটি যে আসলে কুক্কুরী, ততক্ষণে তার কুলোর মতো জিভ প্রদীপের সর্বাঙ্গে বুলিয়ে চলেছে। বলছে, ‘আই লাভ ইউ! লাভ ইউ!’ হাউন্ডের লালায় ভিজতে ভিজতে প্রদীপ সেন মনে মনে তার বাড়ির মেল পেটটিকে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, ‘থ্যাঙ্কু কুট্টুস!’ তার শরীর থেকে নির্গত কুকুরের মেল হর্মোনের ঘ্রাণ কুক্কুরীকে সম্মোহিত করে দিয়েছে, বুঝলেন প্রদীপ!
ততক্ষণে বাংলোর মালিক, সেই অফিসার বের হয়ে এসেছেন। তাঁর এই বাঘের মতো কুকুরের এমন ল্যাজেগোবরে অবস্থা দেখে তিনি তো থ’। প্রদীপকে হাত ধরে নিজের চেম্বারে বসিয়ে প্রথমে চা-জলখাবার পাঠাবার ঢালাও নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘এলসা তো সিংহির মতো দেখতে! ভয়ংকর ওই কুকুরের পাল্লায় পড়েও আপনি অক্ষত আছেন? নিজের ভাগ্যকেই ধন্যবাদ দিচ্ছি আমি। কত লোক যে ওকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে, হার্ট ফেল করেছে, তার ঠিক নেই!’ নিজেই একরকম যেচে যাবতীয় কনট্রাক্ট প্রদীপকে পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন তিনি। বললেন, ‘আমার এলসা আপনাকে ভালবেসে ফেলেছে, এ কী কম কথা!’
অফিসারের বাড়ির বাইরে পা রেখে প্রদীপ ফের বললে, ‘থ্যাঙ্কস্ কুট্টুস! তোর ছড়িয়ে দেওয়া হর্মোন আমাকে শুধু বাঁচালই না, প্রায় কোটি টাকার কাজও পাইয়ে দিল। থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু!’ তারপরেই সে বুঝল, কুকুরেরা সত্যিই গরিবদের পাত্তা দেয় না। বড়লোকদেরই তো কুকুর পোষার ক্ষমতা থাকে, বিলিতি কুকুর।
তাঁদের শরীরে তো দেগে দেওয়া হয় কুকুরের বিশেষ হর্মোন। দেয় সেই পোষ্যরাই। তাই সমস্ত প্রজাতির কুকুরই তো ধনবানদের পদলেহন করে। অনন্তকাল ধরে করেই চলে…।
শনিবারের চিঠি, মার্চ, ২০১৩
অঙ্কনঃ ডি’ সুজা.